কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন নীরবে। ষাট দশকের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে রাজপথ প্রকম্পিত করেছেন একাত্তরের বীর যোদ্ধা মোঃ মোস্তাকিম আলী।  
তার জন্ম পাকিস্তান সৃষ্টির তিন বছর পর ১৯৫০ সালের ১৭ জুলাই তারিখে দিনাজপুর শহরের পাটুয়াপাড়া মহল্লায় অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল এক পরিবারে। পিতা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ তৈমুরউদ্দিন। মায়ের নাম সামেদা খাতুন। প্রাথমিক শিক্ষা পাটুয়াপাড়া পাঠশালায়। এই পাঠশালায় ১ম হতে ৫ম পর্যন্ত প্রতি শ্রেণীতেই ১ম স্থান অধিকার করেছিলেন। দরিদ্র পরিবারে জন্মলাভের পরেও পড়াশোনায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য দিনাজপুর পৌরসভার পক্ষ হতে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। দিনাজপুর পৌরসভা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালিন পৌর চেয়ারম্যান মোঃ মকবুল হোসেন। সেই অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে তাকে ২০০ টাকার চেক উপহার দেয়া হয়েছিল। কাজী সাহেব নামের একজন এডিসি আনুষ্ঠানিকভাবে চেকটি হস্তান্তর করেছিলেন। পৌর চেয়ারম্যান নিজে তাকে উপহার দিয়েছিলেন অনেকগুলো বই। সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান নিজের জীবনের একটি বড় স্মৃতি হয়ে আছে অগ্নিঝরা দিনের এই রাজনৈতিক কর্মীর মনে। 
মোস্তাকিম আলী ১৯৬২ সালে দিনাজপুর একাডেমি স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৬৬ সালে মেট্রিক পাস করেন। যখন তিনি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র তখন প্রথম রাজনৈতিক কর্মসুচি প্রত্যক্ষ করেন। একদিন ৬-৭ জন ছাত্রনেতা ঐ স্কুলের গেটে এসে বলতে থাকে যে, আজ ক্লাস হবে না, আজ ছাত্র ধর্মঘট। মোস্তাকিম আলী সেদিন স্কুলে গেলেও ক্লাস না হওয়ায় বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। সেই ছাত্রনেতাদের দু-একজনকে পরবর্তীতে চিনতে পারেন তিনি। তাদের একজন ছিলেন মিজানুর রহমান (পরবর্তীতে বীরগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের প্রভাষক, নাট্যকার), আরেকজন রামনগরের মোঃ ইসরাইল হোসেন। 
ধর্মঘটের কারণে সেদিন মোস্তাকিমের ক্লাস করা হয় নাই। তাই স্কুল থেকে বাড়িৎ ফেরেন। তিনি বাড়ি ফেরার সময় পাটুয়াপাড়ার বর্তমান ঈদগাহ মাঠের কাছে বেশ কিছু যুবককে জটলা করতে দেখেন। তাদের মধ্যে ছিলেন তার আপন বড় ভাই মোঃ সুলতান, পাটুয়াপাড়া নিবাসী মনসুর রহমান (পরবর্তীতে আদর্শ কলেজের ইসলামী ইতিহাসের প্রভাষক), মনসুরের ছোট ভাই মখলেছুর রহমান, মো. ইসমাইল হোসেন পল্টু (একাত্তরে শহিদ), খাদেমুল ইসলাম (পরে ঠিকাদার), নবিবর রহমান নাবু প্রমুখ। পাটুয়াপাড়ার এই যুবকরা দলবদ্ধভাবে বালুবাড়ির দিকে গেলে কৌতহলবশত তাদের পেছন পেছন যান মোস্তাকিম নিজেও। তিনি বালুবাড়ির ভূবন মোহন ডিসপেন্সারির কাছে গিয়ে দেখেন যে, ঐ এলাকায় আরো শত শত লোকের জটলা চলছে। লোকজন ধীরে ধীরে এসএন কলেজের (বর্তমান মহিলা কলেজ তখন এসএন কলেজ নামে পরিচিত ছিল) দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সেই সব লোক যখন বর্তমান বলাই মোড়ের কাছাকাছি যায়, সেই সময় হঠাৎ করে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় এবং মোস্তাকিম নিজেও দৌড় দিয়ে পালিয়ে যান। পরে জানতে পারেন যে, ছাত্র ধর্মঘটের কারণে পুলিশ মারমুখি হয়ে লোকজনের উপর লাঠিচার্জ করছিল। লাঠিচার্জের কারণে সবাই পালাচ্ছিল। তবে নিজে লাঠিচার্জের ঘটনা দেখতে পান নাই
 পালিয়ে যাওয়ার কারণে। আর এভাবেই ষাট দশকের ছাত্র আন্দোলনের সাথে পরিচয় ঘটেছিল তার। 
 মোস্তাকিম আলী স্কুলে থাকতে থাকতে এক সময় ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে সক্রিয় ছিরেন না। রাজনীতিতে সক্রিয় হন ১৯৬৬ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হওয়ার পর। ঐ কলেজে তখন দিনাজপুর শহরের লালবাগ নিবাসী তিন সহদোর জাফর আলী, জোহাক আলী, জাহিদ আলী পড়তেন। তারা সবাই ছাত্র ইউনিয়নর কর্মী ছিলেন। কমিউনিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তারা পান-বিড়ি-সিগারেট খেতেন না, পোশাকে মার্জিত ছিলেন, বড়দের সম্মান ও ছোটদের শ্নেহ করতেন। প্রধানত তাদের মার্জিত ব্যবহার, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে আকৃষ্ট হয়েই মোস্তাকিম আলী ছাত্র¡ ছাত্র ইউনিয়নে নিজেকে সক্রিয় করে তোলেন। ছয় দফা ও ১১ দফার আন্দোলনসহ সকল আন্দোলনে যুক্ত থাকেন। রাজপথের মিছিলেও শরিক হন। 
তিনি ১৯৬৮ সালে দিনাজপুর সরকারি কলেজ হতে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন এবং ঐ কলেজেই ডিগ্রি ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তেভাগা আন্দোলনের কিংবদন্তী নেতা গুরুদাস তালুকদারের সাথে পরিচয় ঘটে। চিরকুমার গুরুদাস তালুকদার দিনাজপুর শহরের ক্ষেত্রিপাড়ায় ন্যাপ নেতা এ টি এম মকবুল আহম্মেদ হেনার বাড়িতে থাকতেন। মির্জা আনোয়ারুল ইসলাম তানুর মাধ্যমে এই বাড়িতে তার সাথে পরিচয় হয় মোস্তাকিম আলীর। এরপর থেকে প্রায়ই এসে গুরুদাস তালুকদারের সান্নিধ্য লাভ ও তার কাছ থেকে রাজনৈতিক দীক্ষা গ্রহণ করতেন তিনি। 
পার্টির নির্দেশে এক সময় কৃষক সমিতিতেও সক্রিয় হন মোস্তাকিম আলী। জোহাক আলীর নেতৃত্বে চিরিরবন্দরের তালপুকুরসহ দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে কৃষকদের সংগঠিত করেন। খৃষ্টীয় ১৯৬৭ হতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন, কৃষক আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে এত বেশি সক্রিয় ছিলেন যে, রাতের বেলা বছরে তিন মাসও বাড়িতে ঘুমিয়েছেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে তার। রাতে বিভিন্ন শ্লোগান সম্বলিত পোস্টার লেখা, গুরুত্বপুর্ণ স্থানের বিভিন্ন দেয়ালে সেই সব পোস্টার লাগানো, দেয়ালে দেয়ালে চিকা মারাসহ বিভিন্ন কাজের ব্যস্তটায় তখন তার অধিকাংশ রাত ঘুমহীন থাকত। বছরের অধিকাংশ রাতে তার ঘুম শুরু হতো ভোর থেকে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোস্তাকিম আলী প্রথম দিকে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দশ মাইল এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আগমন ঠেকানার জন্য সেখানে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের সাথে কাজ করেন। পার্বতীপুর থেকে রেলপথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দিনাজপুরে যেন আসতে না পারে সেই লক্ষ্যে রেলের কয়েকজন শ্রমিক সহকারে মন্মথপুর এলাকায় রেলের একটি সেতু ভেঙ্গে ফেলেন। পরে গুরদাস তালুকদার সহকারে একটি জীপযোগে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। সেখানে গুরুদাস তালুকদারের নির্দেশে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের পাটন ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যোগ দিয়ে উচ্চতর ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঠিকাদারী পেশায় যুক্ত হন। তিন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক তিনি। এখন রাজনীতির মধ্য না থাকলেও মনের মধ্যে কমিউনিজমকেই ব্যক্তি জীবনের আদর্শ হিসেবে লালন করে থাকেন।